স্বদেশ ডেস্ক: করোনার প্রাদুর্ভাব কাটতে না কাটতেই সিলেটে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে পানির দাম। এক লাফেই সেটি দ্বিগুণ করা হয়েছে। কয়েকজন কাউন্সিলরের আপত্তির মুখেও সিটি করপোরেশনের ভার্চ্যুয়াল সভায় এই দাম বাড়ানো হয়েছিল। এ নিয়ে এখন নগরের মানুষ রাজপথে। দাম কমালেও লাগাতার আন্দোলনের হুমকিও দেয়া হচ্ছে। এই অবস্থায় জনগণের সঙ্গে মাঠে নেমেছেন রাজনৈতিক নেতারাও। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র উভয় দলের নেতারা মাঠে নেমে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে হুঙ্কার ছুড়েছেন। রাজপথের আন্দোলনে ইতিমধ্যে তারা ঘোষণা দিয়ে বলেছেন; পানির দাম না কমালে গণআন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
এরই মধ্যে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীও হয়েছেন কিছুটা নমনীয়। গত বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাগরিক সংবর্ধনায় তিনি প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছেন; পানির দাম পুনর্বিবেচনা করা হবে। কিন্তু মেয়রের এই ঘোষণায়ও স্বস্তি ফিরছে না। বরং দিন দিন আন্দোলন দানা বাঁধছে। গতকাল সিলেট নগরীতে তিন ওয়ার্ডের মানুষের সমন্বয়ে মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়েছে। আর এতে উপস্থিত হয়ে দাম না কমালে আন্দোলন গড়ে তোলার হুমকি দিয়েছেন সিলেট মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুল কাইয়ূম জালালী পংকি। আর প্রথম থেকেই নগরবাসীকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে রয়েছেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সহ-সভাপতি আসাদ উদ্দিন। এছাড়া সাবেক মেয়রপুত্র ডা. আরমান আহমদ শিপলুও আন্দোলনে শরিক হয়ে মাঠে নেমেছেন। এদিকে আন্দোলনের কারণে সিলেট সিটি করপোরেশনের পানির বিল জমা দেয়া থেকে বিরত রয়েছেন নগরবাসী। এতে করে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সিলেট সিটি করপোরেশন। সিলেট সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররা জানিয়েছেন- প্রায় ৬ মাস আগে সিলেট সিটি করপোরেশনের এক ভার্চ্যুয়াল মাসিক সভায় পানির মূল্য বাড়ানো হয়েছিল। ভার্চ্যুয়াল সভায় গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করায় আপত্তি তোলেন মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও সিনিয়র কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ ও মহানগর বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ও সিনিয়র কাউন্সিলর রেজাউল হাসান লোদী কয়েস। তাদের যুক্তি ছিল; যেহেতু করোনাকাল কেটে গেছে, এ কারণে সরাসরি বসে একটি মাসিক সভার আয়োজন করা হোক। এবং ওই সভায় পানির দাম বাড়ানোর বিষয়টি আলোচনাক্রমে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। পাশাপাশি গণশুনানির বিষয়টিও তারা সামনে তুলেছিলেন। কিন্তু সেটি মানা হয়নি। ভার্চ্যুয়াল সভায় বিষয়টিকে অপরিষ্কার রেখেই পাস করা হয়। এরপর যখন গত জুলাই মাস থেকে নগরবাসীর কাছে দ্বিগুণ দাম বৃদ্ধির বিল যাওয়া শুরু করে তখন থেকেই শুরু হয় আন্দোলন। নগরীর কাজিটুলা ও নয়াসড়ক এলাকায় প্রথমেই বিক্ষোভ দেখা দেয়। মাসখানেক আগে কাজিটুলা এলাকাবাসীর কয়েক দফা বৈঠকের পর তারা মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করে। আর এই কর্মসূচিতে গিয়ে শরিক হন মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সহ-সভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ। সভায় বক্তৃতাকালে আসাদ উদ্দিন আহমদ করোনাকালে পানির মূল্য বাড়ানোর সমালোচনা করেন। একই সঙ্গে তিনি দেশের অন্যান্য সিটি করপোরেশনের সঙ্গে পানির মূল্যের পর্যালোচনা করেন। এবং তিনি জানান, করোনাকালে পানির দাম বৃদ্ধি নগরবাসীর ওপর অত্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। মেয়র আরিফ জোরপূর্বক নগরবাসীর ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। এজন্য তিনি পূর্বের ন্যায় পানির মূল্য রাখার আহ্বান জানান। এ সময় আসাদ উদ্দিনের সামনেই স্থানীয়রা কঠোর আন্দোলনে নামার হুমকি দেন। কাজিটুলা এলাকাবাসীর মানববন্ধনের পর নগরীর নয়াসড়কসহ কয়েকটি এলাকায় মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। এসব মানববন্ধনে স্থানীয় কাউন্সিলররা গিয়ে শরিক হন। এবং পানির মূল্যবৃদ্ধি করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তবে কাজিটুলা, নয়াসড়কসহ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করেন- পানির দাম কমানোর দাবিতে যারা আন্দোলনে আছেন তাদের দমিয়ে রাখতে মেয়র আরিফ নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এমনকি ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে জরিমানা করারও হুমকি দিচ্ছেন। এতে মানুষের আরও ক্ষোভ বাড়ছে। এরপর এলাকাবাসীর কর্মসূচিতে শরিক হন সিলেটের সাবেক মেয়র কামরানপুত্র ডা. আরমান আহমদ শিপলু। তিনি এলাকাবাসীর এ আন্দোলনের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। ঘোষণা দেন- পানির দাম না কমালে নগরবাসীর সঙ্গে থাকবেন। শিপলু জানান- করোনাকালে মানুষ জীবিকার যাঁতাকলে ছিলেন। কিন্তু মেয়র আরিফ সিটি করপোরেশনের লোকসানের দোহাই দিয়ে মানুষের ওপরই ট্যাক্স বাড়িয়ে দিয়েছেন। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলে জানান তিনি। এজন্য নগরবাসীর সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি। সিলেট সিটি করপোরেশনের সিনিয়র কাউন্সিলর ও মহানগর বিএনপি নেতা রেজাউল হাসান কয়েস লোদী জানিয়েছেন- সিটি করপোরেশনের যে সভায় পানির বিল বাড়ানো হয়েছে সেটি ছিল ভার্চ্যুয়াল সভা। মেয়র ইচ্ছা করে ওই সভায় ধূম্রজালের সৃষ্টি করে সিদ্বান্তটি পাস করিয়ে আসেন। আমরা আপত্তি জানালেও সেটি মানা হয়নি। তিনি বলেন, নগরবাসীর এ যৌক্তিক আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের একাত্মতা রয়েছে। কারণ মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশনকে প্রশাসনিক কার্যালয় বানিয়ে ফেলেছেন। আর তিনিও একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তার মতো আচরণ করছেন। এটা উচিত না। তিনি দাবি করেন- মেয়রের উচিত দ্রুত আরেকটি মাসিক সভা ডেকে পূর্ব সভার সিদ্ধান্ত বাতিল করা। নতুবা নগরবাসীর সঙ্গে আমরা থাকবো। এদিকে গতকাল সিলেট সিটি করপোরেশন কর্তৃক পানির বিল, হোল্ডিং টেক্স, ট্রেড লাইসেন্সসহ অন্যান্য যাবতীয় বিল বৃদ্ধির প্রতিবাদে নগরীর ৩, ১০ ও ১১নং ওয়ার্ডের জনসাধারণের উদ্যোগে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। রোববার দুপুরে নগরীর রিকাবীবাজার পয়েন্টে এই মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। মানববন্ধনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সিলেট মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক কাউন্সিলর আব্দুল কাইয়ুম জালালী পংকী বলেন, সিটি করপোরেশন হচ্ছে একটি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়বৃদ্ধি কিংবা বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের অজুহাতে পানির মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অগ্রহণযোগ্য। বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে সিলেট সিটি করপোরেশন কর্তৃক পানির মূল্য, হোল্ডিং ট্যাক্স, ট্রেড লাইসেন্সসহ অন্যান্য যাবতীয় বিল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করলে সিসিক’র ২৭টি ওয়ার্ডের জনসাধারণকে নিয়ে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলা হবে। ১১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. বদরুল ইসলাম বদরুর পরিচালনায় মানববন্ধনে উপস্থিত ও বক্তব্য রাখেন- মধু শহীদ পঞ্চায়েত কমিটির সহ-সভাপতি আলাউদ্দিন বাদশা, ১১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. পিংকু আব্দুর রহমান, সহ-সভাপতি আনোয়ার হোসেন আনাই, বিশিষ্ট সমাজসেবক আলী আকবর ফকির, নাজির উদ্দিন রব, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হাজী ছামেদ মিয়া, রোটারিয়া মির্জা সাদ্দাম হোসেন, ভাতালিয়া যুব উন্নয়ন সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নাল আবেদীন, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাজ্জাদুর রহমান আলতা, হাজী আব্দুুল কাইয়ুম, সামসুদ্দিন আহমদ, আনোয়ার বাদশা, সানাউল হক মিতু, হাজী আলমগীর হোসেন, আফসর হোসেন, খসরুজ্জামান, শাকিল মুর্শেদ প্রমুখ।